“If you want to learn to pray, go to sea.”
—Portuguese proverb
“...অথবা খুব বিশাল সমুদ্রের মাঝে, হারিয়ে যাওয়ার মত..."
এভয়েড রাফার কষ্ট গানের এই লিরিক্স দিয়ে বোঝা যায়, কষ্ট আসলে সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়ার মত। 🙂 আপনার মনে কখনো প্রশ্ন জাগে না? যেখানে আমরা নিজেদের পাড়ার মধ্যেই হারিয়ে যাই, এই বিশাল সমুদ্র, মহাসমুদ্রে আমরা হারাই না কেন? হারিয়েছিলাম একসময়। অনেক দক্ষ নাবিক, ক্রু, জাহাজ হারিয়েছিলাম। কিন্তু আস্তে আস্তে আমরা এই সমস্যা সমাধানের পথ বের করে নিয়েছি। সেটা অবশ্যই এক দিনে হয়নি, কয়েক শতাব্দি লেগেছে!
ন্যাভিগেশন ব্যতীত, আমরা খুব সম্ভবত সমুদ্রের কাছে হারিয়ে যাব। ন্যাভিগেশন প্রাচীন প্রাথমিক সভ্যতার পক্ষে নতুন দ্বীপ আবিষ্কার করা, বাণিজ্য রুট স্থাপন এবং বিশ্বের অন্য পাশের লোকের সাথে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হয়েছিল। ন্যাভিগেশন মৎস্যজীবীদের বিদেশের সমুদ্র বন্দরে নিরাপদে যাত্রা করার জন্য ও তাদের বাড়ি এবং বাণিজ্য জাহাজগুলি খুঁজে পাওয়ার সুবিধা দেয়। আজ, ন্যাভিগেশন অনেক নিখুত ও সঠিক এবং নির্ভরযোগ্য ন্যাভিগেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশ্বজুড়ে জাহাজ, বিমান এবং ট্রাককে নির্দেশ দিয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে আমরা অনেকদূর এগিয়ে গেছি।
মেরিন ন্যাভিগেশন প্রাচীন পদ্ধতিতে তারার সাথে নেভিগেট করা থেকে বর্তমানে স্যাটেলাইটের সাথে জাহাজের অবস্থান সন্ধান করা পর্যন্ত অনেক দূর এগিয়েছে। আসুন আমরা ন্যাভিগেশনের আকর্ষণীয় ইতিহাস এবং সামুদ্রিক ন্যাভিগেশন সরঞ্জামগুলি সম্পর্কে জানি যা আমাদের আজ এই আধুনিক নেভেগেশন সিস্টেমে নিয়ে এসেছে।
এই আর্টিকেলে সব বিষয়ই খুব ছোট ছোট করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব যাতে আপনি সাগরের ন্যাভিগেশন সিস্টেম এর সাথে খুব ভালোভাবে পরিচিত হতে পারেন। বিস্তারিত জানতে হলে আর্টিকেলের শেষ উল্লেখ করা কিছু আর্টিকেল বা বই পড়তে পারেন।
এখানে যা যা নিয়ে আলোচনা করব:
A)* ন্যাভিগেশনের সূচনাঃ কেন দরকার হল ন্যাভিগেশন? কিভাবে শুরু হল?
B) প্রাচীন ন্যাভিগেশন পদ্ধতির আদ্যপান্ত ঃ
১)সূর্য দেখে দিক নির্নয়
২)তারার সাহায্যে নেভিগেট
৩)সামুদ্রিক পাখিদের অনুসরণ
৪) আবহাওয়া ও বাতাস পর্যবেক্ষণ
৫) Dead reckoning ( মৃত হিসাব 😑)
* C) বেসিক ন্যাভিগেশন যন্ত্রপাতি( যা এখনো ব্যাবহার হয় মাঝে মাঝে)
১) গভীরতা এবং গতি পরিমাপের সরঞ্জাম
২) মেরিনার্স কম্পাস
৩) ন্যাভিগেশন চার্ট
৪) জোতির্বিদ্যিয় ন্যাভিগেশন সিস্টেমগুলো
5)ক্রোনোমিটার দ্বারা নেভিগেট ( প্রাচীন ন্যাভিগেশনের শেষ ধাপ)
A) ন্যাভিগেশনের সূচনাঃ কেন দরকার হল ন্যাভিগেশন? কিভাবে শুরু হল?
সমুদ্রে ন্যাভিগেশনের প্রথম দিনগুলিতে, নাবিকেরা উপকূলরেখার উপর দিয়ে ভ্রমণ করতেন এবং সর্বদা স্থল দৃষ্টিতে অর্থাৎ তীরের কাছাকাছি থাকতেন। নাবিকরা সমুদ্রের দিকে তাদের অগ্রগতি অনুমান করতে এবং তাদের ভৌগলিক অবস্থান অনুমান করার জন্য উপকূলে ল্যান্ডমার্কগুলির (স্থলচিহ্ন) মধ্যে দূরত্বের বিবেচনা করে। চেনা যায় এমন চিহ্নগুলি ব্যবহার করে, জেলেরা ভাল ফিশিংয়ের জায়গাগুলিতে ফিরে যেতে পারতেন এবং ব্যবসায়ীরা দূরবর্তী বন্দরগুলিতে যেতে পারত।
কিন্তু , এই ভিজ্যুয়াল ন্যাভিগেশন কৌশলটি ব্যবহার করার ফলে সমুদ্র ভ্রমণ তীরের কাছাকাছি সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং কুয়াশাচ্ছন্ন দিনগুলিতে বা আলো কম ছিল এ সময় ভ্রমন চ্যালেঞ্জিং হয়ে যেত। নাবিকরা কেবলমাত্র জাহাজ থেকে দূরের বালুচর অনুসরণ করতে পারত । সেসময় নাবিকেরা সমুদ্রের স্রোত এবং বাতাসের উপর নির্ভর করেই তখন অনুমানের উপরেই গভীর সমুদ্রে প্রবেশ করত।
সময়ের সাথে সাথে, নাবিকরা গভীর বিশাল সমুদ্রের পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য ন্যাভিগেশনের নতুন পদ্ধতিগুলি উদ্ভাবন করেছিল। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে, প্রাচীনকালের প্রাথমিক ন্যাভিগেটররা সূর্য, তারা এবং তাদের আশেপাশের অন্যান্য উপাদানগুলির উপর ভিত্তি করে (আশ্চর্যজনকভাবে!) সঠিক ন্যাভিগেশন কৌশল তৈরি করেছিলেন।যা এখনো কার্যকর এবং ক্ষেত্র বিশেষে ব্যাবহার করা হয় ও বটে।
সেগুলোর কিছু পদ্ধতিই নিচে আলোচনা করা হলঃ
“To reach a port we must set sail –
Sail, not tie at anchor
Sail, not drift.”
― Franklin D. Roosevelt
প্রাচীন ন্যাভিগেশনাল পদ্ধতিঃ
১) সূর্য দেখে দিক নির্নয়
সবচাইতে সহজ পদ্ধতি। কোনও জাহাজের দিক নির্ধারণের অন্যতম সহজ পদ্ধতি হ'ল আকাশ জুড়ে সূর্যের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ । নাবিকরা সূর্যের অবস্থান পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে যাওয়ার সাথে সাথে তাদের রুটকে গাইড করে। দুপুরে, ও বিকালে সূর্যের ছায়ায় পর্যবেক্ষণ করে উত্তর এবং দক্ষিণ নির্ধারণ করতে পারত এবং এখনো পারে।
২) তারার সাহায্যে নেভিগেটঃ
রাতে যখন সূর্য ডুবে যেত , নাবিকরা তখন তারাগুলি ন্যাভিগেট করতে ব্যবহার করত। তারাগুলি পূর্ব থেকে পশ্চিমে আকাশের দিকে চলে এবং কিছু তারা, যারা হরাইজন বা দিগন্তের নিচে তাদের রাতের পথ শুরু করে এবং শেষ করে যাদের ধ্রুব তারা বলে,। নাবিকরা তারা যেভাবে তারা সূর্যের গতিবিধি দেখেছিলেন সেভাবে রাত্রে তারাদের নড়াচড়া দেখে তাদের ধ্রুব তারা নামকরণ করেন । নাবিকরা তাদের অবস্থান ট্র্যাক করতে আকাশের তারাগুলির সাহায্য নিতেন ।
আকাশে রাতে যত উজ্জ্বল বস্তু দেখা যায়, সব কিন্তু তারা নয়। কিছু গ্রহ ও আছে। তারা ও গ্রহের মধ্যে পার্থক্য করার সবচাইতে সহজ পদ্ধতি হচ্ছে, তারারা আকাশে মিটমিট করে যা গ্রহরা করে না । রাতের আকাশের প্রধান দুটি উজ্জ্বল বস্তু যা আমরা দেখি তা কিন্তু তারা নয় তারা গ্রহ। তারা হচ্ছে শুক্র ও বৃহস্পতি । তারাদের ক্ষেত্রে আমরা কি দেখি? সন্ধ্যায় পূর্ব দিক থেকে উঠে রাতে পশ্চিম আকাশে অস্ত যাচ্ছে, তাই তো? এখন যদি প্রতিটি তারাই এভাবে একদিক থেকে উঠে অপরদিকে অস্ত যায় একই ভাবে, আপনার পক্ষে কি কোন নির্দিষ্ট তারা নির্নয় করা ও তা দ্বারা দিক নির্নয় করা সম্ভব? কখনোই না। তার মানে অবশ্যই কিছু তারা আছে যা একদিকে নির্দিষ্ট থাকে। নাহলে তারা চিনবই বা কিভাবে আর দিকই বা কিভাবে নির্নয় করব? এই তারকার নাম ধ্রুবতারা। ইংরেজিতে বলে পোলারিস (Polaris) বা মেরু তারা (Pole Star)। এই তারাটা উত্তর দিকে থাকে।
দেখুন, ধ্রুবতারা থাকে উত্তর আকাশে। অর্থাৎ যেদিকে আপনি ধ্রুবতারা খুজে বের করবেন, তার বিপরীত দিকটা দক্ষিন, ডানে পূর্ব, বাঁয়ে পশ্চিম। এইতো কাজ হয়ে গেল!
তো খুব সুন্দর আপনি ধ্রুবতারা বের করলে দিক নির্নয় করতে পারবেন অর্থাৎ সফলভাবে ন্যাভিগেশন করতে পারবেন। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে রাতে তো আকাশে আপনি অনেক তারা দেখতে পারবেন। এখন আপনি কিভাবেই বা ধ্রুব রারা খুজে বের করবেন আর কিভাবেই বা খুজবেন উত্তর দিক? এখানে আপনাকে হেল্প করলে সপ্তর্ষীমন্ডলী বা Ursa Major
সপ্তর্ষীমণ্ডলী (Ursa Major) মূলত একটি তারামণ্ডলী (Constellation)। এর মধ্যে প্রধান সাতটি তারকা একটি চামচের মত আকৃতি তৈরি করেছে। এই সাতটি তারকাকে উত্তর আমেরিকায় বলে বিগ ডিপার (The Big Dipper) আর ইউরোপে বলে লাঙল (Plough)। এই সাতটি তারকা খুঁজে পাওয়া মোটামুটি সহজ । সাতটি তারকার ৩টি মিলে চামচের বাঁট আর বাকি চারটি তৈরি করেছে মাথা। ছবিতে দেখুন।। প্রথম ছবিতে খুঁজে নেবার চেষ্টা করে ২য় ছবি থেকে মিলিয়ে নিন। ছবি (১ ও ২)
চিত্র ১ ও ২ঃসপ্তর্ষীমন্ডল
এইতো পেয়ে গেলেন সপ্তর্ষীমন্ডল। এখন?
সপ্তর্ষীমন্ডলের যে শীর্ষের ৪ টা তারা মিলে বাটির ন্যায় আকৃতি গঠন করেছে, সেদিকে তাকান। মাথার ডানদিকে যে দুটো তারা আছে ( যেদিকে চামচের হাতল নেই) সেই দুটো তারা কাল্পনীকভাবে যোগ করে আরো একটি সরলরেখা আকুন। সামনের দুই তারকা মিলে যে দৈর্ঘ্য হয় তার চাইতে আরো ৬ গুন বেশি দূরত্ব যান, ,একটা মাত্র উজ্জ্বল বস্তু দেখতে পারবেন যেটা মিটমিট করে না। এটাই হচ্ছে আপনার শুক্রগ্রহ ও শুকতারা।
এইতো পেয়ে গেলেন। কঠিন লাগছে? প্রথম প্রথম একটু কঠিন লাগতেই পারে, চর্চা করলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে মনে রাখবেন, এটা কিন্তু সপ্তর্ষীমন্ডলের অংশ নয়। শুধুমাত্র ধ্রুবতারা চেনার একটা মাত্র উপায় হিসেবে আমরা সপ্তর্ষী মন্ডল ব্যাবহার করেছি। আরেকটা সপ্তর্ষিমন্ডল আছে আকারে ছোট কিন্তু দেখতে এর উলটো, সেটা দিয়েও ধ্রুবতারা বা পোলার স্টার নির্নয় করা সম্ভব। নিচের চিত্রটা দেখলে বুঝতে পারবেন যে পোলার স্টার আসলে ছোট সপ্তর্ষী মন্ডল যার আসল নাম LITLE BEAR এর একটা অংশ।
চিত্র ৩ঃ বিগ ডিপার ও পোলার স্টার
ঠিক এভাবেই তারার সাহায্যে নেভিগেট করা হত ।
আপনাকে অভিনন্দন ক্যাপ্টেন, আপনিও সফলভাবে আপনার জাহাজ ন্যাভিগেট করতে পারবেন!
৩) সামুদ্রিক পাখিকে অনুসরণঃ
অনেক দিন আগের একটি ঘটনা। একটা জাহাজ তার পথ হারিয়ে ফেলেছে। অনেক চেষ্টা করেও পথ খুজে পাচ্ছেন না। এমন সময় একজন ক্রু একটি পাখি দেখেন যার মুখে সম্ভবত একটি মাছ ছিল এবং এটি তা খেতে খেতে জমির দিকে ফিরে যাচ্ছিল। তখন সামুদ্রিক পাখিটিকে লক্ষ্য করে নাবিকেরা স্থলবন্দর খুজে পেয়েছিলেন । ব্যাস! তৈরি হয়ে গেল ন্যাভগেশনের আরেক অধ্যায়! ন্যাভিগেশনের এই পদ্ধতিটি খুব উত্তরে অক্ষাংশে কার্যকর ছিল যেখানে গ্রীষ্মে একাধিক মাস তারাগুলো দেখা যেত না।
কখনো কি ভেবে দেখেছেন যে পাখিরা কীভাবে দিক নির্ণয় করে? এ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে অনেকরকম থিওরিও এসেছে। তবে সম্প্রতি হয়ে যাওয়া এক গবেষণায় জানা গিয়েছে এক নতুন তথ্য।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, পাখিরা পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র বুঝতে পারে। যা তাদের দিক নির্ণয় করতে সাহায্য করে। অবশ্য এই ধারণা নতুন। আগে গবেষকরা ভাবতেন, পাখির ঠোটে আয়রন সমৃদ্ধ কোষ থাকে যা ক্ষুদ্র কম্পাস হিসেবে কাজ করে। তবে নতুন গবেষণায় প্রমাণ হয় যে, পাখির চোখে বিশেষ ধরণের প্রোটিন থাকে। যার কারণে চৌম্বকক্ষেত্র দেখতে পায় তারা।
এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় মূলত কোয়ান্টাম মেকানিজম কাজে লাগিয়ে। প্রোটিনের কোয়ান্টাম ইন্টার্যাকশন বা প্রতিক্রিয়া পাখিদের চৌম্বকক্ষেত্রের অবস্থান সম্পর্কে জানান দেয়। আগের তত্ত্ব বলে, পাখিরা আকাশে ওড়ার সময় কোয়ান্টাম তত্ব ব্যবহার করে চৌম্বক ক্ষেত্র দেখে।
এভিয়ান প্রাণীদের ক্ষেত্রে, পৃথিবী চৌম্বকক্ষেত্রের অবস্থান অনুযায়ী তাদের চোখে বিভিন্ন ধরণের প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। এসব প্রতিক্রিয়া পাখির চোখের বিভিন্ন রঙে চৌম্বকক্ষেত্রের সম্ভাব্য চিত্র তৈরি করে। তবে এই চিত্রগুলো খুব নির্দিষ্ট করে কোন অবয়ব বোঝায় না। শুধু চৌম্বকক্ষেত্রের নড়াচড়া অনুযায়ী সাদা ও কালো রঙের ছায়ার মতো হয়।
যখন আলোর কণা পাখির চোখে প্রবেশ করে তখন এটি ক্রিপ্টোকোমসে { টিনায় আলো-সংবেদনশীল বিশেষ প্রোটিন ক্রাই ফোর (Cry4) }পড়ে। ফলে এটি তাড়িত হয় আর কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গল তৈরি করে। এটি এমন একটি অবস্থা যখন ইলেক্ট্রনগুলো আংশিকভাবে আলাদা হয়। তবে এ অবস্থাতেও একে অন্যের সাথে যোগাযোগ ও প্রতিক্রিয়া করতে পারে এসব ক্রিপ্টোক্রোমস।
চিত্র ৪ঃ পাখির দিক নির্নয় কৌশল
মানুষের চোখে ফটোরিসেপটিভ কোণগুলো তিন ধরণের হয়। প্রতিটি কোণ লাল, সবুজ ও নীল রঙের আলোর প্রতি সংবেদনশীল হয় যাকে ট্রাইক্রোমাটিক কালার ভিশন বলে। তবে পাখির চোখে আরো একটি বেশি কোণ থাকে। যাকে টেট্রাক্রোমাটিক কালার ভিশন বলে। এই অতিরিক্ত একটি কোণের কারণে পাখিরা আলোকরশ্মি ছাড়াও আল্ট্রাভায়োলেট ফ্রিকোয়েন্সিও দেখতে পায়।
এভাবেই পাখিরা দিক নির্নয় করে স্থলপথ খুজে পায়, ও তাদের দেখে আগেরকার নাবিকরা তা দেখে দিক নির্নয় করতে পারতেন।
৪) আবহাওয়া ও বাতাস পর্যবেক্ষণঃ
নির্দিষ্ট অঞ্চলগুলিতে প্রাচীনকালের ন্যাভিগেটররা বাতাস এবং পানির স্রোতের ভিত্তিতে তাদের দিক নির্ধারণ করতে পারত । ভূমধ্যসাগরে, নাবিকরা গরম দক্ষিণ বাতাস এবং ঠান্ডা উত্তর বাতাসের মধ্যে পার্থক্য করেছিল। অবশেষে, আট ধরনের প্রধান বাতাসের নামকরণ করা হয়েছিল এবং এই বাতাসের দিকগুলি পূর্ব দিকের সমুদ্রের চার্টগুলিতে চিহ্নিত wind rose ( যেখানে সব বাতাস একসাথে এক বিন্দুতে মিলিত হয়) বিন্দুতে পরিণত হয়েছিল।
কিছু নাবিক ও দক্ষ পাইলট সমুদ্রের উপরে তাদের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য বাতাসের দিক এবং প্রকার (মূলত তাপমাত্রা) দেখেছিলেন। পলিনেশিয়ান (নিউজিল্যান্ড এর আশেপাশের এলাকা) নাবিকরা প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলির মধ্যে খোলা সমুদ্রকে ভালোভাবে নেভিগেট করতে আঞ্চলিক আবহাওয়ার নিদর্শনগুলি খুব ভালোভাবে অনুসরণ করতেন । প্রায় ৪০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে, পলিনেশিয়ান নাবিকরা মার্কসাস দ্বীপপুঞ্জ থেকে হাওয়াই পর্যন্ত ২,৩০০ মাইল ভ্রমণ করতে সক্ষম হন এবং তারা দিক ঠিক রাখেন বাতাস ও আবহাওয়ার দিক ও প্রকৃতির উপর নির্ভর করে।
৫) Dead reckoning ( মৃত হিসাব 😑) ঃ
এটা ন্যাভিগেশনের আরেকটি গুরত্বপূর্ন ও সফল একটা পদ্ধতি । এ পদ্ধতিতে নেভিগেট করতে কিছু জিনিস জানা থাকতে হয়।
১) জাহাজের বেগ
২) জাহাজটি কোন দিকে যাচ্ছে
৩) কত সময় ধরে যাচ্ছে
জাহাজটিকে সঠিক পথে চালিত করতে ভ্রমণের সময় নেভিগেটররা সূক্ষ্ম রেকর্ড রাখতে হয়। জাহাজের অতীতের অবস্থানের ভিত্তিতে, নাবিকরা উপসাগরের যাত্রার সময় সম্পূর্ন সঠিকভাবে তাদের বর্তমান অবস্থান নির্ধারণ করতে পারে।
তবে, এই পদ্ধতিতে হিসেবটা জাহাজের আদি অবস্থানের উপর খুব বেশি নির্ভর করে, নাবিকরা যদি তাদের গণনায় একটি ছোট ভুল করেন তবে তাদের পথ অনেক দূরে সরে যেতে পারে।আবার , এই প্রোসেস সমুদ্রের স্রোত এবং বাতাসের জন্য আলাদা করে কোন হিসেব করে না, তাই dead reckoning ব্যবহারকারী জাহাজগুলি তাদের গণনা সঠিক রাখলেও ভুল পথে পারে। আগেরকার নাবিকদের অত্যাধুনিক ন্যাভিগেশন প্রযুক্তির অভাব ছিল বলে, dead reckoning ব্যবহার করার সময় ন্যাভিগেশনাল ভুলগুলি স্বীকৃতি দেওয়া ও তা সমাধান করা অত্যন্ত কঠিন ছিল।
বেসিক ন্যাভিগেশন যন্ত্রপাতিঃ
প্রাচীন কাল থেকে নাবিকরা তাদের গতি, অবস্থান এবং ভ্রমণের দিক নির্ধারণের জন্য সামুদ্রিক ন্যাভিগেশন সরঞ্জামগুলি ব্যবহার করতেন। যদিও এই যন্ত্র গুলো প্রথমে অনুন্নত ও প্রাচীন ছিল, পরে গণিত এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে আরও উন্নত ন্যাভিগেশন সরঞ্জামের বিকাশ ঘটে যা সমুদ্র ভ্রমণকে ব্যাপকভাবে প্রসারিত করে।
তারা এবং সূর্যের ও ছায়ার কোণ পরিমাপ করে আগেরদিনের নাবিকদের এই অনুমান করে নিতে হত যে দিগন্ত (হরাইজন) থেকে কত দূরে ছিল এবং তার ভিত্তিতে তাদের অক্ষাংশ নির্ধারণ করতে হয়েছিল। নাবিকরা পরে অবশ্য আকাশের বিভিন্ন তারা এর সাহায্যে অক্ষাংশটি সহজেই নির্ধারণ করতে পারতেন, তবে ক্রনিকোমিটারের (দ্রাঘিমা নির্নয়ের যন্ত্র) এর আবিষ্কার এর আগ পর্যন্ত দ্রাঘিমাংশ সঠিকভাবে মাপা যায়নি। এই দুর্দান্ত প্রযুক্তি সাথে মহাকাশীয় ন্যাভিগেশন ( তারা ) এবং সঠিক সমুদ্রের চার্টের প্রতিনিয়ত আপডেট এর ফলে এবং একই সাথে বিদ্যমান সরঞ্জামগুলির সাথে নাবিকদের দক্ষতা, অনুসন্ধানকারীদের নির্ভুলতা একসাথে বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ সম্ভব করে তুলেছিল।
১) গভীরতা এবং গতি পরিমাপের সরঞ্জামঃ
ধরুন আপনার কাছে একটা লম্বা দড়ি আছে যার নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর একট গিট দেয়া। মোট ১০০ টা গিট আছে দড়ি তে। এরপর আপনি পানিতে ঐ দড়িটা আস্তে আস্তে ছেড়ে দিতে থাকলেন। দড়ির নিচে একটা ভারী জিনিস চাপিয়ে দিলেন যাতে মাটিতে ঠেকলে বুঝতে পারেন। এরপর দেখলেন ৭০ গিট যাওয়ার পরে ওজনটা মাটিতে ঠেকল বলে মনে হল আপনার। তো গভীরতা কত? ৭০ গিট। ব্যাস।
ঠিক এই পদ্ধতিতেই পূর্বে গভীরতা নির্নয় করা হত। প্রচীনকালে জাহাজের ডেকের তলদেশে এরকম একটা দড়ি লাগানো ছিল, যাকে বলা হত লিডলাইন। লিডলাইনের শেষের দিকে সীসার তৈরি ভারী একটা বস্তু লাগানো ছিল। জাহাজের নাবিকেরা এভাবে গভীরতা নির্নয় করে বুঝতেন যে ঐ জায়গাটায় চলাচল নিরাপদ হবে নাকি না।
ষোড়শ শতকের সময়, চিপ লগের আবিষ্কার নাবিকদের তাদের আনুমানিক গতি আরও নির্ভুলভাবে গণনা করতে দেয়। চিপ লগ হল একটা দড়ির মত, যার নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর গিট বা নট দেয়া থাকে। এর প্রান্তে থাকে একটা ভাসমান বস্তু। জাহাজ থেকে বস্তুটাকে পানিতে ফেলে দেয়া হয়।একজন নাবিক দড়িটার একটা প্রান্ত ধরে থাকেন। নির্দিষ্ট সময় পরে দেখা হয় যে কত গিট পথ অতিক্রম করেছে। ওটাকে পরে ঘন্টায় পরিনত করে বেগ মাপা হত এবং এখনো হয়।
ঐ যে দেখলেন কত গিট পথ যায় তা হিসেব করে, ঐ জন্যই জাহাজের স্পিড ন্যাটিক্যাল মাইলে প্রকাশ করা হয়। পূর্বে জাহাজের স্পিড প্রকাশ করা হত Knots এ। knot এর বাংলা অর্থই হচ্ছে গিট।
চিত্র ৫ঃ চিপ লগ
জাহাজের গতি নির্নয়ে চিপ লগ ছিল পূর্বের সকল পদ্ধতির চাইতে উন্নত। আগে জাহাজ থেকে ধনুক ফেলে দিয়ে, পাথর ছুড়ে বা নির্দিষ্ট দূরত্ব পার হয়ে যেতে কত সময় লাগছে তার মাধ্যেম জাহাজের বেগ বের করার চেষ্টা চলত, কিন্তু সেগুলোতে ভুলের পরিমান ছিল অনেক বেশী। চিপ লগ পদ্ধতিতে ভুলের পরিমান এতটাই কম যে বর্তমানেও এর পদ্ধতি প্রচলিত আছে।
২) মেরিনার্স কম্পাসঃ
কম্পাস হল প্রথম দিকের ন্যাভিগেশনাল সরঞ্জামগুলির মধ্যে একটি এবং যেটি বর্তমানেও সামুদ্রিক ন্যাভিগেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। যদিও কম্পাসটি প্রথম কে আবিষ্কার করেছিল তা জানা যায়নি, খ্রিষ্টপূর্ব ৩ হাজার বছর আগে চীন সেনাবাহিনী তাদের সৈন্যদের পরিচালনা করার জন্য চৌম্বকীয় লোহা ব্যবহার করার গল্প রয়েছে। পৃথিবীর পশ্চিম অংশে , সমুদ্রের ন্যাভিগেশন জন্য প্রথম কম্পাস ব্যাবহার হয়েছিল দ্বাদশ শতাব্দীতে, আলেকজান্ডার নেকহ্যামের দ্বারা।
প্রথম দিকের ন্যাভিগেটররা আকাশের তারার সাথে ন্যাভিগেশনে প্রচুর নির্ভরশীল ছিল, তবে মেঘলা দিনে এই পদ্ধতি ব্যাবহার করে ন্যাভিগেশন প্রায় অসম্ভব হয়ে যায় । এর জন্য তৈরি হয় মেরিনার্স কম্পাস । প্রথম দিকের মেরিনার্স কম্পাসগুলি এক টুকরা কাঠের সাথে একটি চুম্বকের ন্যায় কাটাকে একটি বাটিতে পানির মধ্যে রেখে দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। তখনকার দিনে আজকালকার মত কম্পাস সহজলভ্য ছিল না আর এর আকৃতি ও এত ছোট ছিল না।
চিত্র ৬ঃ মেরিনার্স কম্পাস
৩) ন্যাভিগেশন চার্ট:
প্রাচীনকালে, সব নাবিকেরাই কিন্তু ইচ্ছা করলেই সমুদ্র ভ্রমনে যেতে পারত না। কারণ তাদের কাছে যথাযত ম্যাপ ছিল না যে কিভাবে যেতে হবে, কোন দিকে যেতে হবে। এরপর সব নাবিকেরা যৌথ উদ্যোগে এই ন্যাভিগেশন চার্ট বানান। এই চার্টে সমুদ্রের বিস্তারিত ম্যাপ দেওয়া ছিল। যাতে একটা জায়গা থেকে অন্য একটা জায়গায় যাওয়ার রুট ও আশেপাশের দ্বীপগুলো সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যেত।
প্রথমদিকে এই পদ্ধতিতে সীমাবদ্ধতা দেখা দেয়। কারণ আগেরকার নাবিকেরা যে ল্যান্ডমার্ক ব্যাবহার করতেন, তা পরে নষ্ট হয়ে যেত বা খুজে পাওয়া যেত না। যার ফলে সকল নাবিকেরাই যাওয়ার সময় পুরাতন ন্যাভিগেশন চার্টটার সাথে মিলিয়ে যেসব ল্যান্ডমার্ক খুজে পাওয়া যাচ্ছিল না, সেগুলো রিপ্লেস করলেন। তার পরে একই রুটে যাওয়া নাবিকেরাও একইধারা বজায় রাখলেন। এভাবে ক্রমাগত সংশোধনের মাধ্যমেই ন্যাভিগেশন চার্টের সুফল পাওয়া শুরু করি আমরা।ন্যাভিগেশন চার্ট হচ্ছে প্রাচীন ন্যাভিগেশনের সবচাইতে গুরত্বপূর্ন পদ্ধতি।
চিত্র ৭ঃ একটি প্রাচীন ন্যাভিগেশনাল চার্ট
ক্রোনোমিটার দ্বারা নেভিগেট ( প্রাচীন ন্যাভিগেশনের শেষ ধাপ):
প্রাচীন ন্যাভিগেশন এর পথচলা শেষ হয় ক্রোনোমিটার ব্যাবহার করে ন্যাভিগেশন করা শুরু করার মাধ্যমে। ক্রোনোমিটার ব্যাবহার করার মধ্য দিয়েই আমরা আধুনিক ন্যাভিগেশন এর পর্যায়ে প্রবেশ করেছি।
একটি মেরিন ক্রোনোমিটার এমন একটি টাইমপিস যা সঠিক এবং নির্ভুলভাবে যেকোন দ্রাঘিমায় সময়ের মান নির্নয় করতে পারে। সুতরাং এটি একটি নির্দিষ্ট অবস্থানের সময় সঠিকভাবে বের করতে পারে। এরপর এই সময়ের পার্থক্য থেকে মুলবিন্দু থেকে দ্রাঘিমারেখার পার্থক্য বের করা যেতে পারে এবং এভাবেই স্থান নির্ধারণ করা হয়।
ক্রোনোমিটার দিয়ে সময় এর পার্থক্য নির্নয় করে দ্রাঘিমা নির্নয় করা বেশ সোজা। প্রতি ৪ মিনিট সময়ের জন্য দ্রাঘিমার পার্থক্য ১ ডিগ্রি হয়। স্থানীয় সময় ও গ্রিনিচ মানমন্দিরের সময়ের পার্থক্য করা হত এখানে।
চিত্র ৮ঃ ক্রোনোমিটার ঘড়ি।
আধুনিক নেভিগেশনঃ
বর্তমানে আর সেই দিন নেই যখন মেঘাচ্ছন্ন দিনে জাহাজ থামিয়ে ল্যান্ডমার্ক খোজার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আজ আর বিশাল সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়ার তেমন ভয় নেই। এর পুরোটাই আধুনিক যুগের ন্যাভিগেশন ও এর প্রযুক্তির ফসল। আমরা প্রাচীন কালের ন্যাভিগেশন প্রোসেস নিয়ে অনেক জানলাম। এখন একটু আধুনিক যুগের ন্যাভিগেশনের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক।
জাহাজ চালানো বা ন্যাভিগেশন পূর্বেও একটা কঠিন পেশা ছিল, এখনো আছে। তবে প্রযুক্তি জাহাজের ক্যাপ্টেনদের কাজটা সহজ করে দিয়েছে। পূর্বে কোন চার্টে দ্রাঘিমাংশ ও অক্ষাংশ বিবেচনা করে মেরিনার্স চার্টে একটা বিন্দু দিয়ে ক্যাপ্টেনরা জাহাজের অবস্থান বুঝতেন। বর্তমানে মেরিনার্স চার্টের ব্যাবহার খুব কম। তার বদলে চলে এসেছে জি পি এস বা Global positioning system। এটা সম্পূর্ন সাগরে আপনার অবস্থানের সাথে সাথে আশেপাশের জায়গাগুলোর অবস্থান ও বলে দেয়।জি পি এস এখন একেবারেই নিখুতভাবে কাজ করে বলা চলে। আমাদের মাথার উপর যে কৃত্তিম উপগ্রহ গুলো ঘুরছে, তার সাথে সরাসরি সম্পর্ক করে জি পি এস আজ জাহাজের অবস্থান নিখুতভাবে বলে দিতে পারে।
আগেই বলেছিলাম, পূর্বে জাহাজের ক্যাপ্টেনরা নটিক্যাল চার্ট বা হাতে লেখা চার্টের উপর ভরসা করে অবস্থান নির্নয় করে ন্যাভিগেট করতেন। এ পদ্ধতিতে ভুলের সম্ভাবনা ছিল প্রচুর। তবুও পরিমার্জিত হওয়ার পরে এই চার্টগুলো মূল্যবান দলিলে পরিনত হয় ও সহজে যাতে কেউ একে নষ্ট করতে না পারে তাই সরকারের হাইড্রোগ্রাফিক ডাটাবেজে এদের সংরক্ষণ করা হত।
চার্টগুলো যাত্রাপথের আশেপাশের সমস্ত স্থানের বর্ননার দেয়া থাকলেও সমুদ্রের সার্ফেসে হটাৎ উচু বা নিচু স্থান, ব্রিজ, তীরে অবস্থির কাঠামো বা মানবসৃষ্ট কোন জিনিসের বর্ননা দেয়া ছিল না। মানুষ যখন এই ল্যান্ডমার্ক গুলী ধ্বংস করতে থাকল এবং সমুদ্রের বুকে নতুন দ্বীপ গড়ে উঠল তখন আর নাবিকদের পক্ষে আগের চার্ট দ্বারা সফলভাবে ন্যাভিগেট করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাছাড়া ঘনঘন রুট বা চ্যানেলের পরিবর্তন বোঝা এই হাতে লেখা ন্যাভিগেশন চার্টের মাধ্যমে সম্ভব হচ্ছিল না। এভাবে দূর্বল হয়ে পরে এই ন্যাভিগেশন সিস্টেম। আবির্ভাব ঘটে জি পি এস এর!
জি পি এস সিস্টেমের আবিষ্কার প্রথমদিকে তেমন উন্নত ছিল না। যখন থেকে আমরা স্যাটেলাইট ব্যাবহার করে আমাদের জি পি এস সিস্টেম চালনা করা শুরু করলাম, তখন থেকে প্রাচীন ন্যাভিগেশন প্রযুক্তি গুলোর বিলুপ্তি হওয়া শুরু করল। এখনো জাহাজে কিছু কিছু প্রাচীন প্রযুক্তি থাকে বটে, তবে সেটা ব্যাকআপ হিসেবে। বর্তমান জাহাজে ব্যাবহার করা হয় এমন কিছু প্রযুক্তির নিচে দেয়া হলঃ
without a rudder and compass and never knows where he may cast.”
― Leonardo da Vincibin Lee Graham
১) জাইরো / গাইরো কম্পাসঃ
মূলত এটি দিক নির্নয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। চৌম্বকীয় কম্পাস থেকে আলাদা । গায়রো কম্পাস কোনও বাহ্যিক চৌম্বকীয় ক্ষেত্র দ্বারা প্রভাবিত হয় না। এটি উত্তর দিক সঠিকভাবে সন্ধান করতে ব্যবহৃত হয়, যা পৃথিবীর নিজ অক্ষের উপর ঘুর্নন দিক নির্দেশ করে । তবে জরুরী সময়ে দিক নির্নয়ের জন্য এর রিপিটার সিস্টেমকে সবসময় দিক নির্দেশক প্ল্যাটফর্মে উপস্থিত থাকতে হবে।
চিত্র ৯ঃ জাইরো কম্পাস
2. রাডারঃ
সমুদ্রযাত্রায় থাকা জাহাজগুলি ন্যাভিগেশনের জন্য ফ্রিকোয়েন্সি রাডার ( এস-ব্যান্ড এবং এক্স-ব্যান্ড) সিস্টেমের উপর নির্ভর করে কারণ এটি লক্ষ্যবস্তু সহজে সনাক্ত করতে পারে এবং স্ক্রিনে প্রয়োজনীয় তথ্য যেমন স্থল ভূমি থেকে জাহাজের দূরত্ব, কোনও ভাসমান বস্তু (যেমন কোন দ্বীপ, শিলা, আইসবার্গ ইত্যাদি) প্রদর্শন করতে পারে,যার ফলে অন্যান্য জাহাজ বা ভাসমান বস্তুর সাথে সংঘর্ষ এড়ানো যায় । এটি একটি মুভেবল অ্যান্টেনা যা জাহাজের চারপাশের অঞ্চলের তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে।মূলত রেডিও ফ্রিকুয়েন্সি দিয়ে এন্টেনা কাজ করে।
চিত্র ১০ঃ রাডার
৩)কম্পাস বা দিগদর্শন যন্ত্রঃ
খুব বেসিক একটা জিনিস। চৌম্বকীয় বা ম্যাগনেটিক কম্পাস পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের সাথে মিলিতভাবে কাজ করে এবং এটা দিক নির্নয়ের উপযোগী উপায় । কম্পাসের মাধ্যমে আপনি আপনার যাত্রার একটা সম্পূর্ন গাইডলাইন পাবেন। এই জাহাজ ন্যাভিগেশন সরঞ্জাম সাধারণত monkey island এর মাঝামাঝি লাইনে লাগানো হয় যাতে এরা সুরক্ষিত থাকে। প্রতিটি জাহাজে কমপক্ষে একটি ট্রান্সমিটিং চৌম্বকীয় টাইপ কম্পাস লাগানো থাকে যাতে ব্রিজ প্যানেলে আউটপুট প্রদর্শিত হয়।
"monkey island" টার্মটা জাহাজের এমন একটি স্থানকে বোঝায় যা একটি জাহাজের সবচাইতে উচু স্থানে অবস্থিত। এটি মূলত জাহাজের নেভিগেট ব্রিজের উপরে অবস্থিত একটি ডেক। এটি পাইলথহাউস বা চার্ট হাউসের উপরে উড়াল সেতু বা জাহাজের উপরের সেতু হিসাবেও উল্লেখ করা হয়
চিত্র ১১ঃ ন্যাভিগেশন মডিউল
৪) অটো পাইলটঃ
প্লেনের অটোপাইলট বোঝেন তো? সেম কাজ, কোন ডিফারেন্স নাই! জাহাজের ক্যাপ্টেন তো আর রোবোট না যে ২৪ ঘন্টা কাজ করবে। তাই খোলা সমুদ্রে নিরাপদ মনে হলে জাহাজের ক্যাপ্টেন বেশ অনেকদূর পথ অটোপাইলট দিয়ে চালান। এই পদ্ধতিতে ক্যাপ্টেন বেশ কিছু নির্দেশনা আগে থেকেই দিয়ে রাখেন যেমন কত স্পিডে চলবে, কোন দিকে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ক্যাপ্টেনকে এই বিরক্তিকর কাজ থেকে রেহাই দেয় অটোপাইলোট। যার ফলে ক্যাপ্টেন বিরক্ত না হন ও অন্য দিকগুলোতে মনোনিবেশ করতে পারেন।
বর্তমানে শিপ নেভিশনে হিউম্যান অটোপাইলট ও ব্যবহার করা হয়। কম্পিউটার অটোপাইলট সব রুটে ভালোভাবে কাজ করতে না পারলে আগে থেকে ঠিক করে রাখা একজন হিউম্যান অপারেটরের কাছে অটোপাইলটের দায়িত্ব তুলে দেন। দূর থেকে পাইলোটরা শিপকে নিয়ন্ত্রন করে। অনেকটা কম্পিউটার গেমের মত ! এটা হাইড্রোলিক, মেকানিক ও ইলেক্ট্রিকাল সিস্টেমের সমন্বয়ে গঠিত এক আধুনিক অটোপাইলট সিস্টেম।
চিত্র ১২ঃ জাহাজের কন্ট্রোল প্যানেল
৫) ARPA(Automatic Radar Plotting Aid)
এর পূর্নরূপ Automatic Radar Plotting Aid। অনেকটা রাডারেরই বড় ভাই বলা চলে। কাজ ও প্রায় ওরকম। এটা কাছাকাছি থাকা জাহাজ ও অন্য জাহাজের অবস্থান প্রদর্শন করে। এই রাডারটি শুধুমাত্র আশেপাশে থাকা জাহাজ ও নৌকার তথ্য দেয় যাতে রাতের সময় বা মেঘলা দিনে জাহাজটি কোন সংঘর্ষে পতিত না হয়।
বর্তমানে প্রতিটি জাহাজ ASPS এর এডভান্স সিস্টেম ব্যাবহার করায় অনেকটা সংক্রিয় ভাবেই এটা নিজের কাজ করে জাহাজকে দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে।
জাহাজের ন্যাভিগেশন ব্রিজে এই যন্ত্রটা লাগানো থাকে। এটা ক্রমাগতভাবে জাহাজের চারপাশের নিরীক্ষণ করে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক্ষ্যমাত্রার সংখ্যা অর্জন করে, এক্ষেত্রে; জাহাজ, নৌকো, স্থির বা ভাসমান সামগ্রী ইত্যাদি এবং যথাক্রমে তাদের গতি এবং চলাচলের রুট ডিসপ্লে স্ক্রিনে ভেক্টর হিসাবে তাদের উপস্থাপন করে এবং অ্যান্টেনার প্রতিটি টার্নের সাথে তার আশেপাশের নৌকা বা বাধার সাথে দূরত্ব হিসেব করে স্ক্রিনে এলার্ট দেখায় এবং হিসেব করে এই রুট চেঞ্জ না করলে কতক্ষণ পরে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। জাহাজের ক্যাপ্টেন এ সম্পর্কে অবহিত হয়ে যান ও দুর্ঘটনা এডানোর চেষ্টা করেন।
চিত্র ১৩ঃ ARPA
৬) অটোমেটিক ট্রাকিং সিস্টেম:
এই যন্ত্রটা ASAP এর মত, দুর্ঘটনামুক্তভাবে চলাচলের জন্য ব্যাবহার করা হয়। এটা খুব বেশি জায়গা জুড়ে কাজ করে না, তবে নিখুতভাবে আশেপাশে থাকা বিভিন্ন বস্তুর আকার ও জাহাজ হতে তাদের দূরত্ব বলে দিতে পারে। মূলত শব্দের প্রতিফলনের উপরে এটা কাজ করে। এই ট্রাকিং সিস্টেমের বৈশিষ্ট্য হল, এটা গভীর সমুদ্রে থাকা (মোটামুটি ৩০০ মিটারের মধ্যে) কোন সাবমেরিন আসলে শনাক্ত করতে পারে।
এ যন্ত্র খুব স্বল্প এলাকায় কাজ করে। ৮০০ মিটার এলাকাকে এটা ল্যান্ডমাস বা কাজের ক্ষেত্রে হিসাবে গননা করে ও শব্দ তরঙ্গ ছুড়ে ও তা হতে প্রাপ্ত তথ্য প্রোসেস করে জাহাজের ক্যাপ্টেনকে প্রয়োজনীয় তথ্যের জোগান দেয় ও সম্ভাব্য ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে আগে থেকে জানান দিয়ে রাখে।
৭) ETA (estimated time of arrival) নির্নায়ক যন্ত্রঃ
এই যন্ত্রটা জাহাজের গড় স্পিড পরিমাপ করে তার রুটের সাথে তুলনা করে সবমিলিয়ে একটা estimated time of arrival দেখায় যা বিভিন্ন পোর্টের ম্যানজমেন্টে থাকা কর্মীরা দেখতে পারেন। ফলে জাহাজটি আসার আগে তারা প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সেরা নেয়ার সময় পান। এটা মূলত জাহাজের স্পিড ও রুটের দূরত্বের উপর ভিত্তি করে যাত্রাস্থান থেকে গন্তব্যস্থলের যাওয়ার একটা সম্ভাব্য সময় বলে দেয়।
8) ইকো সাউন্ডারঃ
এটা জাহাজে ব্যাবহার করা হয় এমন আধুনিক প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে সবচাইতে আগের। ১০০ বছরের ও আগে থেকে জাহাজে এই যন্ত্র ব্যাবহার করা হয়। এটা লাগানো থাকে জাহাজের নিচের অংশে। এখান থেকে শব্দ তরঙ্গ পানিতে সোজা নিক্ষেপ করা হয় ও শব্দের প্রতিফলন শোনা হয়। এরপর শব্দ দেয়ার ও তার প্রতিফলন শোনার মধ্যবর্তী সময়কে ১৫০০ দিয়ে গুন করে ২ দিনে ভাগ দিলেই বের হয়ে আসে সমুদ্রের গভীরতা। শব্দতরঙ্গ ব্যাবহার করে সাগরের গভীরতা মাপা হয় এ যন্ত্রের সাহায্যে।
৯)ECDIS ( Electronic Chart Display Information System)
এটা উন্নত ন্যাভিগেশনের জন্য ব্যাবহার করা হয়। বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় তথ্য একত্রে দেয়া থাকে ও কন্ট্রোল প্যানেল থেকেই গুরত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়।বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ জাহাজে এই সিস্টেমটা থাকে না। নৌবাহিনীর জাহাজ বা অনেক বড় জাহাজে এই সিস্টেমটা থাকে।
আমরা আজ সমুদ্রে হারিয়ে যাই না আর বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে পারি কারণ আমাদের হাতে এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি গুলো রয়েছে যা দিনকে দিন উন্নত হবে বলে আমরা আশা রাখি। কিন্তু আমাদের আগের ইতিহাস ভুলে যাওয়া চলবে না।আমরা আধুনিক যন্ত্রগুলোও আবিষ্কার করেছিলাম আমাদের পূর্ববর্তী যন্ত্রগুলো থেকে ধারণা নিয়ে। আগামীতেও আমাদের ন্যাভিগেশনের ইতিহাস সম্পর্কে যথাযথ ধারণা নিয়েই নতুন অতি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আবিষ্কারের মিশনে নামতে হবে। :)
বাণীঃ
“If you want to learn to pray, go to sea.”
—Portuguese proverb
“To reach a port we must set sail –
Sail, not tie at anchor
Sail, not drift.”
― Franklin D. Roosevelt
At sea, I learned how little a person needs, not how much.”
― RoHe who loves practice without theory is like the sailor who boards ship without a rudder and compass and never knows where he may cast.”
― Leonardo da Vincibin Lee Graham
রেফারেন্সঃ
পাখির দিক নির্নয় কৌশলঃ https://www.channel24bd.tv/tech/article/118952/পাখিরা-কীভাবে-দিক-নির্ণয়-করে?
ন্যাভিগেশন ও এর ইতিহাসঃ
http://www.waterencyclopedia.com/Mi-Oc/Navigation-at-Sea-History-of.html
https://oceanservice.noaa.gov/navigation/marinenav/
https://en.wikipedia.org/wiki/Navigation
https://www.nps.gov/safr/learn/education/upload/Navigator_intercept.pdf
https://www.formulaboats.com/blog/history-of-navigation-at-sea/#/
আধুনিক যন্ত্রপাতিঃ
https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S2405535216300183
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনরেফারেন্সঃ
উত্তরমুছুনপাখির দিক নির্নয় কৌশলঃ https://www.channel24bd.tv/tech/article/118952/পাখিরা-কীভাবে-দিক-নির্ণয়-করে?
ন্যাভিগেশন ও এর ইতিহাসঃ
http://www.waterencyclopedia.com/Mi-Oc/Navigation-at-Sea-History-of.html
https://oceanservice.noaa.gov/navigation/marinenav/
https://en.wikipedia.org/wiki/Navigation
https://www.nps.gov/safr/learn/education/upload/Navigator_intercept.pdf
https://www.formulaboats.com/blog/history-of-navigation-at-sea/#/
আধুনিক যন্ত্রপাতিঃ
https://www.marineinsight.com/marine-navigation/30-types-of-navigational-equipment-and-resources-used-onboard-modern-ships/
https://www.marineinsight.com/marine-navigation/marine-navigation-systems-and-electronic-tools-used-by-ships-pilot/
https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S2405535216300183
এত বড় আর্টিকেল! �� অনেক সময় নিয়ে পড়তে হবে।
উত্তরমুছুনহ্যা আর্টিকেলটা বেশ বড়। পড়ে ফেলতে পারেন। জানতে পারবেন অনেক কিছুই। অথবা পার্ট পার্ট করেও পড়তে পারেন। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ! :)
মুছুন