মাহতাব মাহদী
/
তানভীর রানা রাব্বি
ডার্ক ওয়েব নিয়ে আমরা সচারচরই অনেক কথা শুনে থাকি। কিন্তু আমরা, সার্ফেস ওয়েব, ডার্ক ওয়েব, ডিপ ওয়েবকে রীতিমত ভুল বুঝি। চলুন আগে সেটা খন্ডন করে আসা যাক।
সার্ফেস ওয়েব: সহজ কথায় সার্ফেস ওয়েব হলো ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের যে অংশ গুগল, বিং এর মতো সার্চ ইঞ্জিনে আন্তর্ভুক্ত থাকে। যেগুলো আপনি গুগল, বিং এর মতো সার্চ ইঞ্জিন গুলো ব্যবহার করে খুঁজে বের করতে পারেন। worldwidewebsize.com -এর হিসাব মতে নভেম্বর ২০২০ পর্যন্ত গুগল এবং রিং সার্চ ইঞ্জিনে মোট 5.63 বিলিয়ন ওয়েব পেইজ ইনডেক্স বা অন্তভুক্ত করা হয়েছে। সে হিসেবে সার্ফেস ওয়েবেব মোট সংগ্রহ এতটুকু বলা যেতে পারে, যেহেতু এরাই সবচেয়ে জনপ্রিয়। 5.63 বিলিয়ন কিন্তু কম নয়। তবে ধারণ করা হয়, এটা মোট ওয়েবের মাত্র ১০ শতাংশ।
ডিপ ওয়েব: সহজ কথায় ডিপ ওয়েব হলো ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের যে অংশ গুগল, বিং এর মতো সার্চ ইঞ্জিনে আন্তর্ভুক্ত থাকে না। অর্থাৎ এসব ওয়েব পেইজগুলো সার্চ ইঞ্জিনে ইনডেক্স করা থাকে না। এখখ প্রশ্ন আসতে পারে “পেইজগুলো সার্চ ইঞ্জিনে ইনডেক্স করে কে?” উত্তর হলো, যে ওয়েবসাইড ডেভেলপ করে। বিভিন্ন ওয়েব সার্চ ইঞ্জিন টুল অফার করে কাজটি করার জন্য। তো সেই টুল ব্যবহার করে ডেভেলপার তার সাইট গুগলের মতো সার্চ ইঞ্জিনগুলোতে অন্তরভুক্ত করে। মুল কথায় আসা যাক।তো যেহেতু সার্চ ইঞ্জিনে আন্তর্ভুক্ত করা থাকে না সেহেতু সেসব ওয়েব পেইজ এক্সেস করার জন্য আপনাকে সেই পেইজের URL বা সাইটের IP address জানতে হবে। আবার প্রবেশের জন্য নির্দিষ্ট পাসওয়ার্ডও লাগতে পারে উক্ত সাইটের ওপর নির্ভর করে। তাহলে আপনি সেটা এক্সেস করতে পারবেন। উদাহরন হিসেবে ধরুন toru-lota-gulmo.cf সাইটটি। এটা কোনো সার্চ ইঞ্জিনে অন্তর্ভুক্ত করা নেই বা আপনি সার্চ করে পাবেন না। তো এখানে মোট ১৫-১৬ টা ওয়েব পেইজ আছে যেগুলা কোনো সার্চ ইঞ্জিনে সার্চ করে পাবেন না। আতএব, এটা ডিপ ওয়েবের অংশ, আপনি সাইটটি শুধুমাত্র toru-lota-gulmo.cf অথবা এর IP address (172.67.168.176, 104.27.156.216, 104.27.157.216) ব্যবহার করে খুঁজে পাবেন। যেহেতু সাইটের একট্রা কোনো প্রটেকশন দেয়া নেই।
ডার্ক ওয়েব: ডার্ক ওয়েব হচ্ছে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের এমন একটি অংশ যেখানে প্রবেশের জন্য নির্দিষ্ট সফটওয়্যার, কনফিগারেশন এবং অথেনটিকেশন প্রয়োজন হয়। এটা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের অংশ হলেও friend-to-friend (F2F) peer-to-peer (P2P) protocol এর মতো overlay network ব্যবহার করে কমিউনিকেশন করে, যেটা সার্ট ইঞ্জিন বা URL জানা থাকলেও সাধারণ ব্রাউজারের কনফিগারেশন দিয়ে প্রবেশ করা যায় না। বিভিন্ন প্রয়োজনে বিভিন্ন overlay network protocol ব্যবহার করে বিভিন্ন সার্ভিস তৈরি হয়েছে। এবং এদের সিকিউরিটি অত্যন্ত শক্ত। এর ফলে বিভিন্ন ভালো/খারাপ/গোপন সেগুলো বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হয়ে এসেছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় ডার্ক ওয়েব নেটওয়ার্ক হচ্ছে Tor (Onion routing)। এছাড়ও I2P, Freenet, AnoNet, GNUnet, IPFS, সরকারি ডার্কনেট সিস্টেম Riffle উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও আগে StealthNet, WASTE, Turtle F2F এর মতো বিভিন্ন সার্ভিস ছিলো, যেটা এখন আর নেই। মজার ব্যাপার হলো, অপনি নিজেও নিজস্ব anonymous network তৈরি করতে পারবেন।
এখন ডার্ক ওয়েব নিয়ে প্রচলতি বহু মিথ বিদ্যমান। এখন প্রশ্ন হলো, আসলে সেগুলো কি সত্য? অনেক ক্ষেত্রেই না। এখানে আমি প্রথমে আলোচনা করব ডার্ক ওয়েব নিয়ে প্রচলিত মিথ ও ভূয়া তথ্য এবং এর ডিবাংক । আর্টিকেলের শেষ দিকে আমি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো ডার্ক ওয়েব আসলে কি!
ডার্ক ওয়েবে প্রবেশ করা বেআইনি
এটা অনেক প্রচলিত একটা মিথ। ডার্ক ওয়েব প্রবেশ করা কখনোই বেআইনি ছিল না এবং পরবর্তীতে হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ডার্ক ওয়েব আসলে আমরা যেমনটা ভাবি সেরকম না। ডার্ক ওয়েবে অনেক ধরনের ওয়েবসাইট রয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ডার্কওয়েবের মাত্র 45% ওয়েবসাইট বেআইনি বাকি সব অফিশিয়াল এবং সবার জন্য উন্মুক্ত। বাকি সবগুলো ওয়েবসাইট বেআইনি হওয়া কারণ ও কিন্তু বেআইনি কর্মকান্ড করা না। আর আপনি চাইলেই বেশিরভাগগুলোতে প্রবেশ করতে পারবেন না কারণ সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। তাছাড়া যেগুলা সচল বা নতুন কোনো, সেগুলা যেহেতু জানেন না। তাই সেটাতে প্রবেশও করতে পারবেন না কোনো মতে।
ডার্ক ওয়েব প্রবেশ করা বিপদজনক কারণ এটাতে প্রবেশ করলে আপনার কম্পিউটার হ্যাক হয়ে যাবে
নাহ, কখনোই হবে না। এটা ভূয়া একটা কথা। কোন ওয়েবসাইটে প্রবেশ করলেই কখনো কম্পিউটার হ্যাক হয়ে যায়না যতক্ষন পর্যন্ত না আপনি তাকে এলাও পার্মিশন দেন। আপনি যদি সেই ওয়েবসাইটে সন্দেহ জনক এক্সেস না দেন ও কোন ফাইল ডাউনলোড না করেন, তবে আপনার কম্পিউটার হ্যাক হওয়ার কোন সন্দেহ নেই।
এটা শুধু ক্রিমিনালদের জন্য
ডার্ক ওয়েবে সব ক্রিমিনালদের বাস, এখানে হ্যাকাররা থাকে, খুনি ভাড়া পাওয়া যায় ব্লা ব্লা ব্লা। না রে ভাই এত সোজা না জিনিসগুলো। ইন্টারনেট সিকিউরিটির ও বিষয় আছে। ডার্ক ওয়েবেও অনেক ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেয়া হয়। ২০১৫ সালে এমন গুঞ্জন জোড়ালো হয়েছিল যে ডার্ক ওয়েবে ভাড়া করা খুনির দ্বারা অনেকে খুন হচ্ছে যার কোন সত্যতা পুলিশ পায়নি। আর শুধু হ্যাকাররা এখানে থাকে না। হ্যাকিং এর জন্য বেশ কিছু সাইট আছে এটা সত্য, কিন্তু বেশিরভাগই ইথিকাল হ্যাকিং এর । ব্লাক হ্যাট হ্যাকাররা ডিপ ওয়েব কোন দোকান খুলে বসে নাই যে যে কেই এক্সেস করতে পারবেন। তারা সেখানে থাকলেও তাদের কমিউনিটি জানবে, আপনি আমি জানবো না। তো প্রবেশও করতে পারবো না।
ডার্ক ওয়েবে রেড রুম আছে
রেড রুম তত্ত্বটা প্রতিষ্ঠা পায় ২০১৩ সালের দিকে। এর থিওরি টা হলো এটা একটা লাইভ ইন্টারেক্টিভ ভিডিও যেখানে আপনি লাইভ কারো দ্বারা কোন খুন করতে পারবেন বা কাউকে টর্চার করতে পারবেন। আসলে এটার কোন ভিত্তি নাই। এবং এটা হওয়ার ও সম্ভব না। কারণ ডার্ক ওয়েবে এখন পর্যন্ত এমন কোন প্লাটফর্মের খোঁজ মেলে নি। আর ইন্টারনেটে খুনি ভাড়া করার যে মিথ টাও শোনেন, ওটাও সম্পূর্ন সত্য না। কেন জানেন? রেড রুম মানে একটা লাইভ ভিডিও। অর্থাৎ আপনাকে লাইভ স্ট্রিমিং করতে হবে। আর কোন না কোনোভাবে সেটা জনসম্মুখে আসতোই, যেমনটা বিভিন্ন ড্রাগ ট্যাফিকের ডার্ক সাইট এসেছে। সে হিসেবে বলা যায় রেডরুমের কোনো অস্তত্ব নেই। এটা শুথুমাত্র একটা ইন্টারনেট গুজব।
ডার্ক ওয়েব জগত পুরোটাই অন্ধকার
না! এটা আসলে অন্ধকার না। যদি আপনি শুথু Tor বা Onion network এর কথাই ধরেন। এখানে এমন না যে শুধু সব লোকাল ওয়েবসাইট তা কিন্তু না। এখানে অনেক অফিশিয়াল ওয়েবসাইট আছে। ফেসবুকেরও অফিশিয়াল .onion সাইট আছে। সেটাতে প্রতি মাসে ১ মিলিয়নের ও বেশী মানুষ ভিজিট করে। অনেক সাধারণ মানুষ আসে এখানে। শুধু যে বে আইনি কাজ হয়, তা কিন্তু না। ৭০%+ ওয়েবসাইট পাবলিক ও পার্সোনাল সার্ভিস যারা বৈধ। ডার্ক ওয়েবের জন্য ব্যাংকিং সিস্টেম আর ইমেইল সিস্টেম ও আছে। এটা পাব্লিকলি ওপেন। নামে ডার্ক আছে মানেই যে এটা অন্ধকার জগত, সেটা কল্পনা করলে আপনি ভুল।
ডার্ক ওয়েবে প্রবেশ করা যায় না; খুব কঠিন
না, ব্যাপারটা একদমই সেরকম না। আপনি নির্দিষ্ট ডার্ক ওয়েব নেটওয়ার্কের জন্য নির্দিষ্ট সফটওয়্যার ব্যবহার করে খুব সহজেই ডুকতে পারেন। যেমন আপনি যদি Tor protocol বা Onion network এ প্রবেশ করতে চান, তাহলে আপনার প্ল্যাটফর্ম অনুযায়ী torproject.org/download ডাউনলোড করে ইনস্টল করে করে এক ক্লিকে onion routing এ কানেক্ট হয়ে যান। তারপর যেকোনো সাইটের URL দিয়ে দিয়ে ডুকে যান। যেমন ফেসবুকের জন্য এড্রেসবারে facebookcorewwwi.onion লিখে খুব সহজেই প্রবেশ করতে পারবেন। আপনি যদি আরেকটি ডার্ক ওয়েব নেটওয়ার্ক I2P তে ডুকতে চান, তাহলে geti2p.net/en/download থেকে আপনার প্ল্যাটফর্ম অনুযায়ী সফটওয়্যার ডাউনলোড করে, ইনস্টল করে এক ক্লিকে কানেক্ট হয়ে যান। তারপর URL দিয়ে প্রবেশ করুন। যেমন FireRabbit এর I2P সাইটে প্রবেশ করতে লিস্ট থেকে firerabbit.i2p সিলেক্ট করে ভুব সহজেই ডুকতে পারবেন।
তো এভাবে খুব সহজেই প্রবেশ করকে পারবেন তথাকথিত মিসটিরিয়াস ডার্ক ওয়েব।
ডার্ক ওয়েবে সবাই গোপন থাকতে পারে
আপনি চাইলেই হ্যাকিং করতেছেন, পর্নোগ্রাফিক সাইট চালাচ্ছেন, খুন করে যাচ্ছেন, কেউ কিছু বলবে না? ইশ!
ডার্ক ওয়েবে আপনি এনোনোমাস থাকেন এটা সত্য, তবে সুদুর পরিকল্পনা করে চাইলেই আপনাকে ধরা সম্ভব। ২০১৭ সালের দিকে Tor ডার্ক ওয়েবের সবচেয়ে ব্লাক মার্কেট সাইট যার নাম ছিল silk road, এর প্রতিষ্ঠাতা কে গ্রেফতার করা হয়। কারণ তিনি অবৈধ বিজনেস করছিলেন। ২০১১-২০১৫ সালে ৩০০+ মানুষকে ডার্ক ও ডিপ ওয়েবে বেআইনি কাজকর্ম করার জন্য গ্রেফতার করা হয়েছিল। সে হিসেবে সহজেই বলা পরিকল্পনা করে আগালে ডার্ক ওয়েব থেকেও ধরা সম্ভব।
Tor, সহ বিভিন্ন ডার্ক ওয়েবে এফবিআই এর ও কিছু সাব ডোমেইন আছে। তারা ম্যালওয়ার ইউজ করে ডার্ক ওয়েবহ্যাকার দের থেকে নিজেদের তথ্যকে সুরক্ষিত রাখতে।
তাই আপনি চাইলেই যে যা ইচ্ছা করে ফেলবেন তা কিন্তু না। Tor আপনার আইপি এড্রেস দেখায় না মাত্র। তবে আপনাকে ট্রেস করার হাজারো সূত্র আপনি ফেলে আসেন। সেগুলা ব্যবহার করে বিভিন্ন ইনটেলিজেন্ট সার্ফিস আপনাকে থরে ফেলবে, এটা অসম্বভ।
ডার্ক ওয়েবে চাইলেই আপনি যেকোন কিছু কিনতে পারবেন
মানি হেইস্টের মত ব্লাক মার্কেট থেকে বোম, অস্ত্র কিনে ফেলা সম্ভব কি? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই না। ডার্ক ওয়েবে কিছু অফিশিয়াল মার্কেটিং সাইট আছে Alibaba, ebay এর মত, এরা নিশ্চই বে আইনি জিনিস এলাও করবে না। বে আইনি জিনিস বিক্রির জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ব্লাক মার্কেট যেটা একসময় সিল্ক রোড লিড করতো। আমেরিকান সার্ভিস প্রোভাইডর ও ইন্টারনেট সিকিউরিটি সার্ভিস মিলে তা বন্ধ করে দেয়। সিল্ক রোডের পরেও ২ টা সাইট ৭ মাস ধরে তাদের বিজনেস কন্টীনিউ করতে পেরেছে তবে ২০১৮ সালে সে দুটো সাইট ও রিমুভ করে দেয়া হয়। এখনা আপাতত সে অর্থে ব্লাক মার্কেটিং সাইট নাই, আর থাকলেও সেটা পাব্লিকলি ভিজেবল না।
পরিশেষে, আপনি যদি একটু বেশি প্রাইভেসি চান এটা ব্যাবহার করতে পারেন। কোন সমস্যা নাই। তবে হ্যা, সাধারণ ওয়েবের চাইতে এখানে অফেন্সিভ কন্টেন্ট বেশী। ডার্ক ওয়েবকে বলা হয় a space beyond the control of individual states । এখানে কারো ভয় ছাড়াই আপনি নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারবেন। শুধু এটুকুই।
ডার্ক ওয়েব নিয়ে আর কোন মিথ আসুক তা অবশ্যই কাম্য না। লোকজনের অতিরঞ্জিত করার কারণে সাধারণ মানুষের কাছে এটা ভয়ের ও আতংকের নামে পরিনত হয়েছে। তাই আমাদের উচিত সত্যটা জানা।
Refarence :
Refarence :
উত্তরমুছুনhttps://rb.gy/iufs2n
https://rb.gy/4en0eu
https://rb.gy/mr3unb
https://rb.gy/6dsael