সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

একজন অস্তিত্বহীন গনিতজ্ঞ

 Structures are the weapons of the mathematician.


— Nicolas Bourbaki


উপরের কথাটি বলেছেন ফ্রান্সের একজন গনিতবিদ। নিকোলাস বোরবাকি। সারাবিশ্বে অনেক পরিচিত এই গণিতবিদ। টপ ২৫ গণিতবিদের একজন। তার লেখা বই , থিওরি এখনো ব্যাবহার হয় বিশ্বের অনেক জায়গায়। তবে তাকে নিয়ে লোকজনের শুধু একটাই ছোট্ট সমস্যা। সেটা হচ্ছে, এই মানুষটার আসলে কোন অস্তিত্ব নেই। মানে, নিকোলাস বোরবাকি নামে যে বিশ্বসেরা গণিতবিদ , উনি আসলে নেই।


আমেরিকান ম্যাথমেটিকাল সোসাইটি হল বিশ্বের সেরা গণিত সংগঠনের মধ্যে একটা। অনেকটা বিশ্বের ম্যাথ ক্লাব এর মত যেখানে বিশ্বসেরা গণিতবিদেরা আবেদন করেন যুক্ত হওয়ার জন্য এবং তার কাজ কর্ম বিবেচনায় তাকে সেই এলিট ক্লাবের অংশ করা হয়। নিকোলাস বোরবাকি ১৯৫০ সালে এই ক্লাবে যুক্ত হওয়ার জন্য আবেদন করেন, তাকে না করার কোন কারণ ছিলনা ম্যাথমেটিকাল সোসাইটির কাছে। কিন্তু এরপরেও তিনি এই ক্লাবের অংশ হতে পারেননি। কারণ তিনি আসলে অস্তিত্বমান নন। ২০ বছর ধরে পুরো দুনিয়া বোরবাকির নামে ধোকা খেয়ে এসেছে।


একটু পেছনে ফিরে যাওয়া যাক। ১৬ বছর পেছনে ১৯৩৪ সালে।ফ্রান্সের প্যারিসের École normale supérieure এর 5 জন স্টুডেন্ট লাতিন কোয়াটারে একটা গোপন মিটিংয়ে বসেছেন। তাদের সবার উদ্দেশ্য একটাই। গণিতের জন্য সারা বিশ্বে একটা সার্বজনিন নিয়ম তৈরি করা। আসলে সেই সময়টাতে গণিতের কোন সূত্র বা কনজেকচার প্রকাশের কোন সার্বজনিন নিয়ম ছিলনা। যে যার মত প্রকাশ করত। যেমন ধরা যাক কেউ যদি এবসুলুট ভ্যালুকে লেখত |x| আকারে , আবার অন্যেরা প্রকাশ করত [{x}] আকারে বা অন্য কোন প্রকাশভঙ্গিতে। যার ফলে সেটা অন্যদের বোঝার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা সৃষ্টি করত। তাছাড়া তাদের তখনকার টেক্সটবই গুলোও ছিল বোঝার জন্য বেশ কঠিন। তাই তারা দলগত ভাবে চেষ্টা করতে লাগলেন একটা ভালো , সহজে বোধগম্য ও সবার জন্য একটা বই প্রকাশ করার জন্য।


আস্তে আস্তে তারা নিজেদের দল বড় করতে থাকলেন। Henri Cartan , Claude Chevalley ,Jean Coulomb ,Jean Delsarte ,Jean Dieudonné, Charles Ehresmann ,Szolem Mandelbrojt ,René de Possel , André Weil এর মত প্রতিভাবান ছাত্রের সাথে, Roger Godement , Alexander Grothendieck , John Tate যুক্ত হলেন তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে। সবাই মিলে গঠন করলেন বিশ্ববিখ্যাত বোরবাকি কংগ্রেস। যা পরবর্তিতে পুরো গণিত বিশ্বকেই পরিবর্তন করে ফেলেছিল ।


বোরবাকি কংগ্রেসের মূল লক্ষ্য ছিল দুটো। প্রথমত গণিতের জন্য একটা আদর্শ প্রকাশভঙ্গি নিয়ে আসা, আরেকটি হল একটা ভালো টেক্সটবুক প্রকাশ করা। কিন্তু যার তার আর্টিকেল বা রিসার্চ পেপার বা বই তো আর কেউ ছাপাবে না। তাছাড়া যদি কংগ্রেসের কারো একজনের নামে এসব করা হয়, তবে বাকি সবাই ক্রেডিট পাবেনা। ফলে ভাঙন সৃষ্টি হবে। এই পরিস্থিতি সমাধানে তারা তৈরি করলেন একজন ছদ্ম গণিতবিদ , নিকোলাস বোরবাকি , যার আসলে কোন অস্তিত্বই নেই। নিকোলাস বোরবাকি নিজেকে উচ্চশিক্ষিত গণিতবিদ হিসাবে আখ্যায়িত করে বিভিন্ন জায়গায় আর্টিকেল প্রকাশ করতে লাগলেন। তার লেখার ধরন দেখে অনেকে তাকে অনেক বড় মাপের গণিতবিদ ভাবা শুরু করলেন । আস্তে আস্তে আর্টিকেল লেখার সাথে সাথে তিনি বই ও লেখা শুরু করলেন। প্রকাশ হল নিকোলাস বোরবাকির নামে। তবে পেছনে থাকল সেই বোরবাকি কনগ্রেসের গনিতবিদরা।


লোকজন বলত , বোরবাকি কখনই কারো সাথে দেখা করতেন না। লোকজনের আড়ালে থাকতেন। খুব অল্প কিছু লোকের সাথেই তার কথাবার্তা হত। আর্টিকেল বা বই প্রকাশ সবই হত চিঠি আদান প্রদানের মাধ্যমে। তখনকার দিনে এগুলো স্বাভাবিকই ছিল। দুনিয়া চিনল এক নিকোলাস বোরবাকিকে। আর বোরবাকি কংগ্রসের গণিতবিদরা তাদের লক্ষ্য অর্জন করলেন। এখন পর্যন্ত বোরবাকির নামে ১২ টা বই বের হয়েছে। তার প্রথম প্রকাশিত বই ছিল Theory of Sets । এরপর বীজগণিত , জেনারেল টপোলজি থেকে শুরু করে তার সর্বশেষ বই ছিল আলজেব্রিক টপোলজির উপরে।


বোরবাকি কনগ্রেসের মেম্বার হওয়া কিন্তু খুব সহজ ছিলনা। এই ক্লাবের অংশ হতে অনেক প্রতিভা ও পরিশ্রমের দরকার হত এবং অনেক বাছাই করা হত। ১৯৩৪ সাল থেকে ২০০০ পর্যন্ত মাত্র ৪০ এর কাছাকাছি মানুষ এই কনগ্রেসের সদস্য হতে পেরেছেন। বোরবাকি কংগ্রেস কিন্তু মোটেও কোন সিরিয়াস বিষয় ছিল না। এটাকে বোরবাকি কংগ্রেসের সদস্যরা একপ্রকার প্রাংক বা মজা হিসেবে নিয়েছিলেন। জিনিসটাকে বাস্তবসম্মত করার লক্ষ্যে তারা বোরবাকির মেয়ের বিয়ের কার্ড ও অনেককে পাঠিয়েছেন। এমনকি যারা তাকে নিয়ে সন্দেহ বা সমালোচনা করত, তাদের ও উচিত জবাব দেয়ার চেষ্টা করেছেন। প্রায় ২০ বছর সমস্ত দুনিয়া আর গণিতবিদদের ধোকা দিয়ে অবশেষে ১৯৬৮ সালে বোরবাকি কনগ্রেস এই মজা বা প্রাংক ইতি করার সিদ্ধান্ত নেন।


১৯৬৮ সালে এই কংগ্রেস মনে করে তারা আর তাদের কাজ ঠিকঠাক করতে পারছেন না। যার ফলে ১৯৬৮ সালে তারা তার মৃত্যু ঘোষনা করে প্রকাশ করেন। এবং এভাবেই মারা যান এক অদ্ভুত গনিতবিদ , যিনি কখনো জন্মই নেননি।


নিকোলাস বোরবাকি , একজন কাল্পনীক গণিতিবিদ যার পেছনে ৪০ জন গণিততজ্ঞ দিনরাত শ্রম দিয়ে গেছেন আমাদের জন্য গণিতের দুনিয়াকে সহজ করে দেওয়ার জন্য। গণিতে তাদের অবদান প্রায় সবাই একবাক্যেই স্বীকার করেন। তবে ২০ বছর দুনিয়াকে ধোকা দেওয়ার জন্য অনেকে তার সমালোচনাও করেন। তবে যাই হোক, নিকোলাস বোরবাকির ছদ্মনামে কাজ করে যাওয়া গণিতবিদরা নিজেদের লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়েছেন , এতটুকু বলাই যায়।


নিকোলাস বোরবাকির এই ঘটনা থেকে উদ্দিপ্ত হয়ে অনেকেই চেষ্টা করেছেন এমন কিছু করার। যদিও বা সে অর্থে সফল হয়নি প্রচেষ্টাগুলো । ইউরোপের একটা দেশে কয়েকজন কলেজছাত্র চেষ্টা করেছিলেন নিজেদের পাঠ্যবই নতুন করে লেখার জন্য। তবে বোরবাকি কনগ্রেস যেভাবে তা করে গেছে, সেভাবে আর কেউ করতে সক্ষম হয়নি। হয়তোবা হবেও না আর।


ছবিঃ


১) ১৯৩৯ সালের বোরবাকি কংগ্রেসের মিটিং।


২) নিকোলাস বোরবাকির নামে যে ছবি ব্যাবহার করা হত।


৩) বোরবাকি কংগ্রেসের মূল কমিটি


৪) নিকোলাস বোরবাকির লেখা প্রথম বই।







মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ইনফার্টিলিটি ( infertility ): কেন জীব তার প্রতিরূপ তৈরি করে রেখে যেতে পারে না? প্রতিরোধ ও করণীয় ।

  ইনফার্টিলিটি ( infertility ): কেন জীব তার প্রতিরূপ তৈরি করে রেখে যেতে পারে না? প্রতিরোধ ও করণীয় ।  সব প্রজাতিই তার বংশধর রেখে যেতে চায়। মানুষ যেমন সন্তানের জন্ম দেয়, তেমন অন্যান্য প্রজাতিও দেয়। তবে , অনেক সময় তারা সন্তান জন্মদিতে সক্ষম হয়না। কেন হয়না, কি কারণ , কি করা উচিত তা নিয়ে এই আর্টিকেলে বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করব। অর্থাৎ মানুষের ইনফার্টিলিটি নিয়ে বিস্তারিত থাকবে।  আমাদের মধ্যে এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা সন্তান জন্মদিতে পারছেন না বা সক্ষম না। ইংরেজিতে একে বলা হয় , infertility বাংলায় বন্ধ্যাত্বতা। আমাদের মধ্যেও এই রোগে আক্রান্ত অনেকেই আছেন। শুধু আমেরিকাতেই ১০ - ১৫ % ( ১৫-৪৪ বছরের)  দম্পত্বি বন্ধ্যা বা ইনফার্টাইল। বাংলাদেশে একেবারে সিরিয়াস ভাবে সেরকম কেস স্ট্যাডি না হলেও, অনেকগুলো রিসার্চ এ পাওয়া গেছে, বাংলাদেশের বন্ধ্যাত্বতার রেট ৬% এর মত। পাশের দেশে ৭.৭% এর মত। সংখ্যাটা বিশাল। তো ইনফার্টিলিটি আসলে কি? “ যদি টানা এক বছর frequent, unprotected sex করার পরেও যদি কোন কাপল প্রেগনেন্ট না হন , তবে সেই কাপলটি ইনফার্টাইল”  ইনফার্টিলিটি হতে পারে দুইজনের একজনের কারণে অথবা দুইজনের কারণেই। রে

ডার্ক ওয়েব মিথ

মাহতাব মাহদী / তানভীর রানা রাব্বি ডার্ক ওয়েব নিয়ে আমরা সচারচরই অনেক কথা শুনে থাকি। কিন্তু আমরা, সার্ফেস ওয়েব, ডার্ক ওয়েব, ডিপ ওয়েবকে রীতিমত ভুল বুঝি। চলুন আগে সেটা খন্ডন করে আসা যাক।  সার্ফেস ওয়েব: সহজ কথায় সার্ফেস ওয়েব হলো ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের যে অংশ গুগল, বিং এর মতো সার্চ ইঞ্জিনে আন্তর্ভুক্ত থাকে। যেগুলো আপনি গুগল, বিং এর মতো সার্চ ইঞ্জিন গুলো ব্যবহার করে খুঁজে বের করতে পারেন। worldwidewebsize.com -এর হিসাব মতে নভেম্বর ২০২০ পর্যন্ত গুগল এবং রিং সার্চ ইঞ্জিনে মোট 5.63 বিলিয়ন ওয়েব পেইজ ইনডেক্স বা অন্তভুক্ত করা হয়েছে। সে হিসেবে সার্ফেস ওয়েবেব মোট সংগ্রহ এতটুকু বলা যেতে পারে, যেহেতু এরাই সবচেয়ে জনপ্রিয়। 5.63 বিলিয়ন কিন্তু কম নয়। তবে ধারণ করা হয়, এটা মোট ওয়েবের মাত্র ১০ শতাংশ। ডিপ ওয়েব: সহজ কথায় ডিপ ওয়েব হলো ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের যে অংশ গুগল, বিং এর মতো সার্চ ইঞ্জিনে আন্তর্ভুক্ত থাকে না। অর্থাৎ এসব ওয়েব পেইজগুলো সার্চ ইঞ্জিনে ইনডেক্স করা থাকে না। এখখ প্রশ্ন আসতে পারে “পেইজগুলো সার্চ ইঞ্জিনে ইনডেক্স করে কে?” উত্তর হলো, যে ওয়েবসাইড ডেভেলপ করে। বিভিন্ন ওয়েব সার্চ ইঞ্জিন টুল অফার কর